রাজশাহী : রাজশাহীতে মৌসুমের সর্বোচ্চ বৃষ্টি রেকর্ড করা হয়েছে। রাজশাহীতে একদিনে বছরের সর্বোচ্চ ২৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।
বুধবার রাত ১১টা থেকে বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) সকাল ৭টা পর্যন্ত ৮ ঘন্টায় বৃষ্টি হয়েছে ১৬১ মিলিমিটার। যা চলতি বছরের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত বলে জানিয়েছে রাজশাহীর আবহাওয়া অফিস। আর ২৪ ঘন্টায় হওয়া ২৪৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে জানিয়েছে রাজশাহী আবহাওয়া অফিস।
এদিকে, এ রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে নগরজুগে দেখা দেয় ব্যাপক জলাবদ্ধতা। অফিস-আদালত, বাড়ি-ঘর, সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের নিচতলায় দেখা দেয় হাঁটুপানি। এমনকি নগরীর কাদিরগঞ্জ-হেতেম খাঁ, সিএন্ডবি-কোর্ট, উপশহর-তেরোখাদিয়া, বহরমপুর, লক্ষীপুরসহ অন্তত ২৫-৩০টি রাস্তায় কমর থেকে হাঁটুপানিতে ডুবে যায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরের কয়েকটি সড়কেও দেখা দেয় হাঁটুপানি। এতে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েন নগরবাসী। পানি সরাতে কোথাও কোথাও শ্যালো মেশিন চালাতেও দেখা গেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকায় খেওয়া জাল এবং মশারি দিয়ে মাছ শিকার করতেও দেখা গেছে। কোথাও কোথাও নৌকা নিয়ে রাস্তায় চলাচল করতে দেখা গেছে নগরবাসীকে। পানির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্টানগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতিও তেমন ছিলো না।
সচেতন নগরবাসী বলছেন, অপরিকল্পিত উন্নয়ন, নগরীতে অবাধে পুকুর ভরাট, ওয়াসার গাফিলতি এবং ড্রেনগুলো ময়লা-আবর্জনায় পরিপূর্ণ থাকার কারণে একদিনের বৃষ্টিতে ডুবে গেছে নগরীর নিম্নাঞ্চলগুলো।
রাজশাহীর আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগার সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসের বেশ কয়েকদিন থেকে বৃষ্টিপাত হচ্ছে। তবে সামান্য। কখনো হালকা কখনো গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিপাত হয়েছে। তবে চলতি মৌসুমে ২৪ ঘণ্টায় ১৬৬ মিলিমিটার বৃষ্টির রেকর্ড এই প্রথম।
রাজশাহী আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের পর্যবেক্ষক আব্দুস সালাম বলেন, ‘বুধবার (৪ অক্টোবর) রাত ১০ টার আগে রাজশাহীতে বৃষ্টিপাত হয়েছে ৫ মিলিমিটার। একই দিন রাত ১১ থেকে পরের দিন বৃহস্পতিবার (৫ অক্টোবর) সকাল ৭ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৬১ মিলিমিটার। এখনো বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। আর বুধবার বিকেল ৪টার থেকে বৃহস্পতিবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয়েছে ২৪৪ মিলিমিটার। যা গত ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ বলে মনে হচ্ছে।’
তিনি আরও জানান, পুরনো রেকর্ডপত্র না থাকায় এই মূহুর্তে বৃষ্টিপাতের রেকর্ডের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তবে রাজশাহীতে বুধবার রাত থেকে বৃস্পতিবার দুপুর পর্যন্ত হওয়া বৃষ্টিটা স্মরণকালের রেকর্ড বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে।
এদিকে, নগরীর তেরোখাদিয়া এলাকার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা তৈয়বুর রহমান গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে বলেন, ‘বুধবার রাত ১১টার দিকে রাজশাহীতে ব্যাপক বৃষ্টিপাত শুরু হয়। এর পর রাত তিনটার দিকে ঘরের ভিতরে পানি উঠতে শুরু করে। ভোরের দিকে পানি খাটের কাছাকাছি চলে আসে। উপায়ন্তর না পেয়ে ঘরের জিনসপত্র খাটের ওপরে রাখেন তাঁরা। বাড়ির বাইরেও কমর পর্যন্ত পানি। পানির কারণে ঘরবন্দি হয়ে আছি আমরা। আমাদের মতো এই এলাকার শত শত পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে।’
একই অবস্থা নগরীর নতুন বিলশিমলা এলাকার আরিফুল ইসলামের বাড়িতেও। গতকাল বেলা ১২টার দিকে গিয়ে দেখা যায়, বাড়ির ভিতরের নিচতলায় হাঁটুপানিতে সয়লাব। পানি সরানোর জন্য তিনি একটি শ্যালো মেশিন ভাড়া করে নিয়ে এসে পানি সেঁচ দিচ্ছিলেন। তবে কিছুক্ষণ পরেই আবার মুশলধারে বৃষ্টিপাত শুরু হলে তাঁর বাড়ির পানি গতকাল দুপুর ২টায় এ প্রতিবেদন লিখা পর্যন্ত একটুও কমেনি। ওই এলাকার বেশ কয়েকজনকে খেওয়া জাল অর মশারি নিয়ে রাস্তায় মাছ ধরতেও দেখা গেছে।
নাজমুল হোসেন নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘রাস্তায় জাল ফেলে মাছ মারা যাবে, কখনো কল্পনাও করিনি। আজ সেটিও দেখা গেলো।’
মাছ ধরতে থাকা আতিকুর রহমান নামের এক ব্যক্তি বলেন, প্রায় দেড় ঘন্টা চেষ্টা করি এক কেজির মতো মাছ ম্যারিছি। তোড়্যা (খেওয়া) জাল দিয়ে মাছ ম্যারেছি। চ্যালা, ছোট মাছ, আইখোড়, ত্যালাপিয়াসহ বিভিন্ন জাতের ছোট সাইজের মাছ ম্যারেছি। আমার জীবনে এমন ঘটনা এটা প্রথম।’
আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বাড়িসহ আশে-পাশের শত শত বাড়ির নিচতলা ডুবে গেছে। রাস্তায় কমর পর্যন্ত পানি উঠে গেছে। মানুষ ঘরের বাইরে যেতে পারছে না। আমরা রাজশাহীর স্থানীয় বাসিন্দা। কিন্তু এর আগে কখনোই এমন জলাবদ্ধতা দেখিনি আমরা।’
নগরীর অভিযাত এলাকা উপশহরের সবকটি রাস্তা হাঁটুপানিতে ডুবে গেছে। ওই এলাকার শত শত বাড়ির নিচতলা ডুবে গেছে পানিতে। ওই এলাকার বিভিন্ন রাস্তাতেও জাল মশারি নিয়ে মাছ শিকার করতে গেছে অনেককেই। স্থানীয় বাসিন্দা আকবর হোসেন ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, শহরজুড়ে এতো উন্নয়ন হয়েছে, কিন্তু ড্রেনগুলো পরিস্কার করা হয়নি। ড্রেনের পানি উপচে রাস্তা ডুবে গেছে। রাস্তার পানি বাড়িতে ঢুকছে।’
এদিকে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, ডিআইজি অফিস, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, রুয়েট, কোর্ট চত্তরসহ নগরীতে শতাধিক অফিস চত্তর ডুবে গেছে পানিতে। জলাবদ্ধতার কারণে গতকাল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিত খুবই কম ছিল। রাজশাহী কলেজের অধ্যক্ষ আব্দুল খালেক বলেন, ‘বৃষ্টি আর জলাবদ্ধতার কারণে আজ (গতকাল) শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি অর্ধেকের নিচে ছিল।’
বেসরকারী সংস্থা পরিবর্তনের রাজশাহী নির্বাহী পরিচালক ও জেষ্ঠ্য সাংবাদিক রাশেদ ইবনে ওবায়েদ বলেন, ‘নগরীতে যাচ্ছে-তাইভাবে শত শত পুকুর ভরাট হয়েছে গত কয়েক বছরে। এখনো পুকুর ভরাট থামেনি। এ কারণে বৃষ্টির পানি ধরে রাখার কোনো জায়গা নাই। আর সেই পানি এখন ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। আবার ড্রেনগুলো সময়মতো পরিস্কার করা হয় না। ময়লা-আবর্জনায় ভর্তি ড্রেনগুলো দিয়ে ঠিকমতো পানি নামছে না। এর ফলে এক রাতের বৃষ্টিতে নগরজুড়ে যে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে-তাতে ব্যাপক ভোগান্তি নেমে এসেছে সাধারণ মানুষের মাঝে।
রাজশাহীতে জলাবদ্ধতার কারণ নিয়ে সচেতন নাগরিক কমিটি সনাকের রাজশাহী জেলা সভাপতি আহমেদ সফিউদ্দিন গতকাল তার ফেসবুকে একটি পোস্ট করেন।
সেটিও পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
১. দশ বছরেও সড়কের মাঝে নীচ দিয়ে বড় মোটা পাইপে সুয়ারেজ লাইন করতে ওয়াশার ব্যর্থতা।
২. হাইকোর্টের নির্দেশনা না মেনে শত শত পুকুর ভরাট।
৩. পদ্মার বাঁধে বৃটিশ আমলের স্লুইস গেটগুলি থেকে নগরীর উত্তরে প্রবাহিত ড্রেনগুলি ছোট করে ফেলে পাবলিককে স্পেস দখলের সুযোগ করে দেয়া এবং পানি প্রবাহ ধীরগতি করা। ঢালেরও পরিবর্তন করা। ২৫ বছর আগে রাসিকের ড্রেনেজ প্রকল্পের এই আত্মঘাতী ভুলের ওপর ভিত্তি করেই আজও প্রাইমারি, সেকেন্ডারি ও টারসিয়ারি ড্রেনেজ প্রকল্প চলছে।
৪. আবর্জনা ও পলিথিন ফেলে ড্রেনের প্রবাহে বাধাদান। জনসচেতনতা তৈরি ও আইন প্রয়োগে ব্যর্থতা।
৫. বর্ষার আগে আগে ড্রেন পরিস্কার যথাযথ না হওয়া।
৬. নগরীর উত্তরের খাল বিল নদী ভরাট, দখল ও বেআইনী স্থাপনার কারণে পানি নামতে বাধা।
৭. নীতিমালা না মেনে ভবন নির্মানকারীদের বিরুদ্ধে আরডিএর ব্যবস্থা গ্রহনে ব্যর্থতা। জলাশয় ভরাটের পর জমির শ্রেনী পরিবর্তন করে ভবন নির্মানের অনুমোদন দেয়া গুরুতর অপরাধ কীনা তা অনুধাবনে প্রশাসনিক ব্যর্থতা।
৮. হাইরাইজ ভবন, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ১০০ বছরের উন্নয়ন মহাপরিকল্পনা না করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন।
৯. মাটি ও ঘাসের আস্তরণ পানি শোষন করে। উদ্যান, পার্ক, মাঠ, স্কুল, কলেজ, গৃহ সবই কংক্রিট এবং টাইলসে মুড়ে দেয়া হচ্ছে। রাসিক জিরো সয়েল প্রকল্প করে সড়কের দুপাসের হেরিংবোন বন্ডের স্পেস কার্পেটিং করেছে।
১০. সড়ক পুনঃনির্মান ও সংস্কারের সময় নিয়মানুযায়ী উচ্চতা ও ঢাল অনুরূপ না রেখে বছরে বছরে উঁচু করায় নগরজুড়ে ড্রেনের ঢালও এলোমেলো হয়ে গেছে। বাড়ি নিচু হয়ে পানি ঢুকে পড়ছে।
১১. উন্নয়ন পরিকল্পনা করার আগে বিধি মোতাবেক বিশেষজ্ঞ, অভিজ্ঞ এবং নাগরিকদের পরামর্শ গ্রহনে ব্যর্থতা।
১২. জনপ্রতিনিধি ও নাগরিকদের উদাসীনতা।
অন্যদিকে, নগরীর প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা শেখ মামুন ডলার বলেন, ‘ব্যাপক বৃষ্টির কারণে নগরীতে জলাবদ্ধদা হয়েছে। তবে দ্রæত পানি নেমে যাবে। অধিকাংশ ড্রেনের মুখগুলো বন্ধ গেছে ময়লা-আবর্জনা ফেলার কারণে। পুকুর ভরাটও জলাবদ্ধতার অন্যতম কারণ।’